প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর যেসব সদস্য অন্যায়, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার মতোই সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত সদস্যদেরও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।’
বিগত সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত তিন বাহিনীর চাকরিতে বৈষম্য, বঞ্চনা, অবিচার ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়া অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত অফিসারদের আবেদন পর্যালোচনা করে যথার্থ সুপারিশ পেশের জন্য গঠিত কমিটি আজ রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিলে তিনি এই মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যখন আপনাদেরকে এই কাজটি করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল সামান্য কিছু অনিয়ম হয়ত হয়েছে। কিন্তু আপনারা যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে এনেছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। এটা কল্পনার একেবারে বাইরে।’
তিনি কমিটির সদস্যদের পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্য উদঘাটনের জন্য ধন্যবাদ জানান।
আব্দুল হাফিজ জানান, কমিটি গত ১৯ আগস্ট ২০২৫ প্রথম সভা করে। পরে সেন্ট্রাল অফিসার্স রেকর্ড অফিস, আইএসপিআর ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ, গণমাধ্যম ও টিভি স্ক্রলের সহায়তায় ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়।
তিনি জানান, তিন বাহিনীর নিজ নিজ তদন্ত বোর্ড যেসব কর্মকর্তার বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে ডোসিয়ারে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে বোর্ডের সুপারিশ ছাড়াও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কমিটি আরও কিছু আবেদন বিবেচনা করেছে।
অনেক আবেদনকারী সম্পর্কে কমিটির সদস্যবৃন্দ মতামত দিয়েছেন, আবেদনের যথার্থতা ও বঞ্চিত হওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাদের মতামত নির্মোহভাবে কমিটিতে উপস্থাপন করেছেন বলে জানান জেনারেল হাফিজ।
তিনি বলেন, কমিটি ভুক্তভোগী অফিসারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অধিনায়ক ও ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।
কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদনকারীদের মধ্যে ছয় জন অফিসারকে তাদের আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দরুন বা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অপবাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিভিন্ন মেয়াদে (১ বছর হতে ৮ বছর পর্যন্ত) গুম করে রাখা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজির বিহীন। এমনকি একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, পরবর্তীতে ওই অফিসারের স্ত্রীকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক বছরের শিশুসহ বিনা বিচারে দুই দফায় দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে রাখা হয়।
তদন্তে আরও জানা যায়, কিছু সংখ্যক অফিসার ২০০৯ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাযজ্ঞের নারকীয় ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রীয়তায় সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে পাঁচ জনকে একটি ভুয়া ঘটনা (ব্যারিস্টার তাপস হত্যা প্রচেষ্টা মামলা) সাজিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।
তদন্তে জানা যায়, পাঁচ জন অফিসার ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআইতে কর্মরত থাকাকালীন তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে কিংবা বিনা অভিযোগে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, কিছু অফিসার বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে প্রশ্ন করার জন্য সেনাসদর কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এক পর্যায়ে ওই দরবারে ব্যাপক হৈচৈ ও হট্টগোল হওয়ায়, পাঁচ জন অফিসারকে অযথা দায়ী করা হয় এবং তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
চারজন কনিষ্ঠ অফিসার (লেফটেন্যান্ট পদবির) ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ম-নিষ্ঠার সাথে পালন করার কারণে তাদেরকে কোনো একটি দলের অনুসারী হিসেবে অথবা জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় বলেও বেরিয়ে আসে তদন্তে।
কমিটি সেনাবাহিনীর ১১৪ জন বঞ্চিত কর্মকর্তার জন্য স্বাভাবিক অবসর, পদোন্নতি, অবসরের আগে পদোন্নতি, বকেয়া বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের সুপারিশ করেছে। এদের মধ্যে চারজনকে পুনর্বহালের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
নৌবাহিনীর ১৯ জন এবং বিমান বাহিনীর ১২ জন কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুপারিশ করেছে কমিটি
আবেদনকারীদের মধ্যে সেনা বাহিনীর ১২৫ জন, নৌবাহিনীর ৫১ জন এবং বিমান বাহিনীর ২৫ জন সদস্য ছিলেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন মো. আশরাফ উদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ তারিক।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল