জুলাই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগবিহীন ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তে’ সরকারি সহায়তায় গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে রাষ্ট্র। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করে তাদেরকে যেভাবে সহায়তা দিচ্ছেন এটা নজিরবিহীন। বাংলাদেশে আগেও ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে গড়ে ওঠা অনেক রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাসীনরা নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করলেও এবারের মতো এমন নগ্নভাবে করেনি।
রাষ্ট্রীয় তহবিলের তছরুপ করেই কেবল নয়, তাদেরকে পুলিশ-র্যাবের সহযোগিতা ছাড়াও দেওয়া হচ্ছে সামরিক সহযোগিতা।
এনসিপি ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির নামে দেশের জেলায় জেলায় সাংগঠনিক সফর করছে। এই সফরে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা পাচ্ছে। স্বাভাবিক সহায়তায় কারো আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু যে ধরনের সহায়তা তারা নিচ্ছে এবং পাচ্ছে এটা অস্বাভাবিক। আমরা দেখছি তাদেরকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পেতে। সামরিক যুদ্ধযান নিয়ে তারা বিভিন্ন জেলায় সফর করছে। কিছু দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে দেশে যেন যুদ্ধ চলছে।
গত ১৬ জুলাই ‘মুজিববাদের কবর’ দিতে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ যাওয়া কিংস পার্টি এনসিপি ‘মুজিববাদকে রক্ষা’ করতে উন্মুখ বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে উদ্ধারে সেনারা প্রথমে গুলি চালাল বেসামরিক মানুষদের ওপর, এরপর যুদ্ধযানের ভেতরে লুকিয়ে এনসিপি নেতাদের ‘পালিয়ে যেতে’ সাহায্য করল। এটা করা হলো সামরিক বাহিনীকে দিয়ে।
পুলিশ-সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে গোপালগঞ্জে নিহত হলো অন্তত ৫ জন। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি আছে, তবু সরকারি ভাষ্যের ৫ জনকে আমলে নিলেও এই মৃত্যু উল্লেখের। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কাপড় ব্যবসায়ী, রিকশাচালক ও শ্রমিক। অর্থাৎ এরা রাজনৈতিক কর্মী নয়। স্রেফ বেসামরিক মানুষ। মৃতদের সবাই গুলিবিদ্ধ, এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী যে গুলি চালিয়েছে, সেটা অস্বীকার করেনি।
ঘটনার পরের দিন গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়’ বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গোপালগঞ্জের ঘটনা প্রসঙ্গে এতে বলা হয়, সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারংবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর ওপর বিপুল সংখ্যক ককটেল ও ইট পাটকেল ছুড়ে হামলা করে এবং এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গোপালগঞ্জ জেলায় একটি রাজনৈতিক দলের জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে আহ্বানকৃত জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে এলাকার একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা গত ১৬ জুলাই সংঘবদ্ধভাবে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিক আহত হন।
এছাড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। উক্ত রাজনৈতিক সংগঠনের সমাবেশ চলাকালীন মঞ্চে পুনরায় হামলা চালানো হয় এবং একই সঙ্গে জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গকে খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। সর্বোপরি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদারিত্ব ও ধৈর্যের সাথে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।”
সেনাবাহিনী যদিও দাবি করেছে আত্মরক্ষার্থে তারা বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে, তবে কিছু ভিডিয়ো সেটা অন্তত বলে না। সেনাবাহিনীকে সাঁজোয়া যান নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ধাওয়া করতে আমরা যেমন দেখেছি, তেমনি শুনেছি ‘গুলি কর, গুলি কর; সরাসরি গুলি কর’, এমন আওয়াজও। যুদ্ধকালীন অবস্থা, এবং একপাক্ষিক এটা; যদিও যুদ্ধযান, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষ। এমন অবস্থায় অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। যদিও সীমাবদ্ধ স্বাধীনতার গণমাধ্যমের যুগে বেশিরভাগই সামনে আসেনি। বেশিরভাগ গণমাধ্যম এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিভিন্ন বাহিনীর গুলি এবং গুলিতে নিহতের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল এনসিপির ওপর হামলার বিষয়টি।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গোপালগঞ্জের ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু সে সব বিবৃতিতে মানুষের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাদের সকলের বিবৃতিতে ঝরছিল গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিমেয় ঘৃণার প্রকাশ।
অনেকের বিবৃতিতে গোপালগঞ্জবাসী উদ্ধৃত হচ্ছিলেন সন্ত্রাসী ও হামলাকারী হিসেবে।
এনসিপি-বিএনপিসহ ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষের মৃত্যু নাড়া দিতে পারেনি মূলত গোপালগঞ্জবাসীর অধিকাংশের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে। জন্মগত কারণে তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী। সারাদেশে যেখানে আওয়ামী লীগ কার্যত নিষ্ক্রিয়, সেখানে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোপালগঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান হওয়ার সুবাদে মহাকাব্যিক একাত্তর সালেও তারা যেমন ছিল, এখনো আছে তেমনই। সেই গোপালগঞ্জে গিয়ে ‘মুজিববাদকে কবর’ দেওয়ার হুমকি নব্য রাজনীতিকদের কীভাবে তারা সহ্য করে? সেটা করেওনি।
গোপালগঞ্জ সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক সাধারণ মানুষদের গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা, বাড়িবাড়ি অভিযান, নির্যাতন, গণমামলা, গণগ্রেপ্তার, শত শত লোকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার নানা তথ্য এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে দেশের মানবাধিকার সংগঠনসহ সুশীল সমাজের দৃষ্টি এখানে আকর্ষিত হয়নি। গত জুলাইয়ে চারদিকে যেমন মানবতা ও মানবাধিকার জাগরূক হয়েছিল, গোপালগঞ্জবাসীর অধিকাংশের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে এখানে এটা নেতিয়ে পড়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা এটাকে এড়িয়ে গেছে আওয়ামী লীগবিদ্বেষ ও দলটির ‘ফিরে আসার ভয়ে’ যেন অনেকটাই!
১৭ জুলাই ‘গোপালগঞ্জে চার জনের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না’ মন্তব্য করে বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক। সংগঠনটি এনসিপির রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে হামলা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা জানায়। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলে, নিহত চারজনের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না। একই সঙ্গে এনসিপির নেতা – কর্মীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি জানায় সংগঠনটি। অবিলম্বে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করার আহ্বান জানায় তারা।
আসক বলে, গোপালগঞ্জে যেভাবে জনসাধারণের ওপর বল প্রয়োগ ও গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড ও সংবিধান উভয়েরই চরম লঙ্ঘন এবং যা একান্তই অগ্রহণযোগ্য। অতিরিক্ত বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে এই মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতিতে বলে “মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দায়িত্ব হলো এই অধিকার সুরক্ষা করা এবং যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সময়ে উত্তেজনা প্রশমন ও মানুষের জীবন রক্ষা নিশ্চিত করা।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োচিত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং গুলির শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে আসক বলেছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক গণমাধ্যমে বলেছেন পুলিশ মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি। তাহলে এই আগ্নেয়াস্ত্র কারা ব্যবহার করল? এমন প্রশ্ন রেখে সংগঠনটি বলছে, “আসক মনে করে, এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও প্রামাণ্য ব্যাখ্যা দেওয়া না হলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, ভয় ও প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়বে।”
আসক মানুষ হত্যার বিপরীতে বিবৃতি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ জন শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছেন এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে। এরবাইরে আরও ২১ জন নাগরিক বিবৃতি দিয়েছে দুকূল রক্ষা করে। ওই সব বিবৃতিতে মানবাধিকার যতখানি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল ততখানি গুরুত্ব পায়নি। এরবাইরে বিভিন্ন মহল অনেকটাই নিশ্চুপ।
এর কারণ প্রথমত এখনো জুলাই আন্দোলনের পক্ষের মানুষজনের অনেকেই যারা গত আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অ্যাক্টিভিস্ট ছিল, তারা মনে করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার বাংলাদেশে নেই; তারা এখনো মনে করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার নাই বাংলাদেশে, নাই বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও। তাই সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী যখন পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারে গোপালগঞ্জে, তখনও তারা চুপ হয়ে থাকেন। এনসিপি যখন গোপালগঞ্জ যাওয়ার আগে থেকে উস্কানি দিয়ে যায়, সেখানে গিয়েও যখন উস্কানি দেয়, তখন বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদ তাদের কাছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারকে তোয়াক্কা করছে না, তখন এই মুহূর্তের দেশের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ একেবারেই চুপ। ফলে স্বেচ্ছাচারিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগকে ঠেকিয়ে দিয়ে নির্বাচনে মরিয়া সরকার ও ক্রিয়াশীল সকল দল। সুশীল সমাজ সেটাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এনসিপিকে যখন সরকার রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা ও দলটির নেতাদের প্রহরী বানিয়ে ফেলেছে, তখন যেমন চুপ সবাই, তেমনি চুপচাপ সেনাবাহিনীও। নিবেদনের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে তারা মাঠেঘাটে। ফলে সামরিক বাহিনীকে দিয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অথচ সামরিক বাহিনীর কাজ বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলকে প্রতিষ্ঠা করা নয়।
সামরিক বাহিনী যে এনসিপির প্রহরী হিসেবে কাজ করছে এটা কেবল দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আসেনি; এসেছে বিশ্বমিডিয়াতেও।
রয়টার্স, আলজাজিরা, এপিসহ বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থাগুলো যে সব প্রতিবেদন ও ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে, সেটা আমাদের সেনাবাহিনী ও আমাদের দেশের জন্যে সম্মানজনক নয়। যুদ্ধযান ও তাক করা প্রাণঘাতী অস্ত্র; পেছনে ধোয়ার কুণ্ডলী, এমনও ছবি প্রকাশ করেছে তারা।
আইএসপিআর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করেছে, আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছুঁড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোঁড়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেনি, পুলিশকে আক্রমণ করেনি। গোপালগঞ্জে জনসভাস্থলে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ তাদের ক্ষোভ ছড়িয়েছে সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেওয়ার মাধ্যমে। এমনটা বাংলাদেশে আগে হয়নি এমন না, কিন্তু এটাকে মানুষ হত্যার করতে গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল না।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যারাক ছেড়ে বাইরে থাকা সামরিক বাহিনীর ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা তাদের থাকলেও গুলি করে মানুষ মারার মতো নিশ্চয় নয়। এখানে কি পুলিশ সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমে বসা উপদেষ্টাদের দিকনির্দেশনা কাজ করেছে? তারা কি মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন? উপদেষ্টারা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, এটা গোপনীয় থাকেনি। এলজিআরডি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ প্রকাশ্যে ফেসবুকে এসে লিখেছেন: ‘সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের ভেঙে *** দেওয়া হবে। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে সবকিছু মনিটরিং এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা।’
পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া তার এখতিয়ার বহির্ভূত হলেও আসিফ মাহমুদ সেটা দিয়েছেন, যা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসেই উল্লিখিত। ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের ভেঙে *** দেওয়া হবে’ বলে যা লিখেছেন, তার ফল দেখা গেল ওই দিনই ৪ জনের মৃত্যুতে, অগণন মানুষের আহতের হওয়ার সংবাদে।
সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম দেখা গেল সরকারের দায়িত্বশীল কাউকে এভাবে মানুষ-বধের নির্দেশনা দিতে। তাও আবার অন্য একটা মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করে!
জুলাই আন্দোলনে মানুষের হতাহতের ঘটনা নিয়ে সরকার বিচার করছে। বিভিন্ন মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলা সেই সব বিচারে রাষ্ট্রপক্ষ বলতে চায় শেখ হাসিনা ‘খুনের নির্দেশদাতা’। তারা নানাভাবে এটা প্রমাণ করতে চায়। অথচ শেখ হাসিনার প্রকাশ্য নির্দেশনা দালিলিক নয়, এটা কেবলই তাদের দাবিকৃত। এখন যে পরিস্থিতি দেশে, তাতে সরকারের উপদেষ্টারা নির্দেশনা দিচ্ছেন, ফেসবুকে সেটা সচিত্র প্রকাশও করছেন; আগে এমন ছিল না। তবু বিচার হচ্ছে, এবং ধারণা করা হচ্ছে তারা বিচারিক আদালতে তাদের চাওয়ামতো রায়ও পেয়ে যাবেন। দালিলিক প্রমাণ ছাড়াও যদি শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ শাস্তির দণ্ডের আশা করতে পারে এখানে সরকার ও জুলাইয়ের আন্দোলনের পক্ষের লোকজন, তবে ভবিষ্যতে এমন সচিত্র প্রমাণ থাকার পরে কি অদ্যকার উপদেষ্টা ও সরকারপক্ষের লোকজন রেহাই পাবেন? প্রশ্নটা আগামীর কাছেই থাকল।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো গোপালগঞ্জে গুলি করে মানুষ মেরেছে। এরপর থেকে সেনাপ্রহরায় এনসিপি বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন করছে। যুদ্ধযান নিয়ে যাচ্ছে এনসিপির কর্মসূচির নিরাপত্তা দিতে। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-সোয়াত-ডগ স্কোয়াড সব আছে তাদের নিরাপত্তা দিতে। এটা কী রকম পরিস্থিতি? রাষ্ট্রীয় কোন বাহিনী বিশেষ করে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর কাজ কি কোন বিশেষ দলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করা? তারা রাষ্ট্রের নাকি এনসিপির দলীয় বাহিনী? বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কি কোন নজির আছে কোন বিশেষ দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সেনাবাহিনী যুদ্ধযান নিয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার? এটা কি তাদের ওজন-আবেদনের সঙ্গে মানানসই?
জুলাইয়ের আন্দোলন দিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর এনসিপি সরকারি সহায়তায় গড়ে ওঠেছে। তাদের দলের কেউ কেউ তারা জুলাই আন্দোলনের সংগঠক ঠিক, কিন্তু তারা জুলাই আন্দোলনের একমাত্র স্টেক হোল্ডার নন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এছাড়া এনসিপি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদনের পর তারা দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলের মতোই একটা দল।
এখানে যুদ্ধযান নিয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সেনাদের নিয়োগ দেওয়া একদিকে যেমন সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে, অপরদিকে বাকি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি বৈষম্যও করা হচ্ছে।
এনসিপিকে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সামরিক বাহিনীকে কেন দায়িত্ব দেওয়া হবে? এটা কি আত্মঘাতী হয়ে যায় না? তবে কি নির্বাচনের সময়েও তারা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী থেকে বিশেষ আনুকূল্য পাবে? অপরাপর রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি স্রেফ আওয়ামী লীগ ও গোপালগঞ্জবাসীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের বিষয়কে আমলে নিচ্ছে না, কিন্তু এটা সার্বক্ষণিক অনুশীলনের পর্যায়ে যে যাচ্ছে না, সেটা কীভাবে নিশ্চিত হবে তারা? একই পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে সরকার যদি এনসিপির পক্ষে কাজ করায়, তখন প্রতিবাদের সময় থাকবে কারো?
অদ্যকার যে পরিস্থিতি, এবং সেনাবাহিনীকে বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত রাজনৈতিক দলের প্রহরী হিসেবে ব্যবহারের যে ঘটনা ঘটেই চলেছে, এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্রমে আস্থা হারাচ্ছে। অথচ এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
গত বছরের জুলাইয়ের আন্দোলনের পথ ধরে আগস্টের রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সেনাবাহিনীও ছিল উল্লেখের মতো ভূমিকায়। ইউনূসের যে ইন্তেরিম সেটা সেনাপ্রধানের দৃশ্যমান দৌড়ঝাঁপে গঠিত হয়েছিল। সেনাপ্রধানের সেদিনের বক্তব্য এবং ‘দায়িত্ব নেওয়ার’ যে ঘোষণা সেটা অবিদিত নয় কারো কাছে। তবু আওয়ামী লীগের প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মীসমর্থকেরা ছিলেন সেনাপ্রধানের পক্ষে দীর্ঘদিন। এটা আরও বেশি জোরদার হয়েছিল যখন বিদেশে বসে কিছু মব-অ্যাক্টিভিস্ট সেনাপ্রধানকে নিয়ে নানা কটূক্তিমূলক কথা বলে। তারা প্রতিদিনই
সেনাপ্রধানকে পদচ্যুত করার কথা বলত, আর বিপরীতে আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা প্রতিদিনই সেনাপ্রধানকে দিয়ে ‘ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন’ দেখত। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা মব-অ্যাক্টিভিস্টদের পাল্টা দিতে গিয়ে সেনাপ্রধানের পক্ষে কথা বলে, এবং তারা সেনাপ্রধানকে তাদের আশ্রয় ভাবতে শুরু করে। এর সঙ্গে আরও যোগ দেয় নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের নানা সময়ে নানান কথাবার্তা। অথচ সেনাপ্রধান স্রেফ একটা বাহিনীপ্রধান। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা বাহিনীপ্রধানই। নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের ধারাবাহিক বক্তব্যগুলো মূলত বাড়াবাড়ি। তিনি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়ার কেউ নন। এটা করবে নির্বাচন কমিশন এবং যথারীতি সরকারের সম্মতিতে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আওয়ামী লীগকে নিয়ে নিজে রয়েছেন পয়েন্ট অব নো রিটার্নে।
আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তার বাহিনীর উল্লেখের মতো ভূমিকা ছিল; এটা তিনি যেমন জানেন, তেমনি জানে সবাই। সামাজিক মাধ্যমে সেনাপ্রধান ও ইন্তেরিমপ্রধানের দূরত্ব নিয়ে নানা কথা একটা সময়ে ডালপালা মেলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধান নিজে সরকারের অধীন একজন কর্মকর্তা এবং এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তার ওপর ভালোভাবেই রয়েছে। চাইলেই তিনি সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। গেলে আইনিভাবে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হবেন। এটা ইন্তেরিমের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সাবেক সরকারের ক্ষেত্রেও। তার পক্ষে তাই এখন ইন্তেরিমের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন কিছু করতে; কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে সেই খড়গ তার ওপর থেকে সরবে না।
এনসিপির নিরাপত্তায় এখন রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এভাবে যদি সেনাবাহিনী বিতর্কিত হতে থাকে, তবে আখেরে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। ইউনূসের ইন্তেরিম আজীবন ক্ষমতায় থাকবে না, কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের রাষ্ট্রীয় একটা বাহিনী; তারা তাদের ভাবমূর্তি হারাতে থাকলে দেশেরই ক্ষতি।
সেনাবাহিনী বিতর্কের হাত থেকে বাঁচুক; সেনাবাহিনীকে বিতর্ক থেকে বাঁচান; তাদেরকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। তারা কারো ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী হয়ে থাকলে বাহিনীরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। কারো ব্যক্তিগত এবং বিশেষ উদ্দেশ্যের কোন দল ও সরকারের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সেনাবাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এভাবে ধ্বংস হতে পারে না। সরকার আসবে, সরকার যাবে; কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তার গৌরব নিয়ে টিকে থাকতে হবে।
ময়মনসিংহের জনতার কন্ঠ।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল