Header Ads Widget

১৭৬২: চট্টগ্রামের সেই ভয়াল ভূকম্পন। পুনরাবৃত্তি সংকেত....?

🕰️ ১৭৬২ সালের সেই অভিশাপ: যে দিন কেঁপে উঠেছিল চট্টগ্রামের পৃথিবী

২রা এপ্রিল, ১৭৬২ সাল। তারিখটা একটি ধূসর প্রচ্ছদ, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক ভয়াল গল্প। বাংলা বর্ষপঞ্জীর পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া এক বিকাল ৫টা। তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন সবেমাত্র চট্টগ্রামে ডানা মেলতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই শাসনের পনেরো মাস পেরোতেই প্রকৃতি তার এক ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হলো।

💥 বিকালের শান্ত সমুদ্র, তারপরই ১৫টি কামান-গর্জন!

চট্টগ্রামের আকাশে সেদিনও হয়তো অন্য সাধারণ দিনের মতোই সূর্য ঢলছিল। উপকূলে লেগে ছিল শান্ত সমুদ্রের বাতাস। কিন্তু শান্ত প্রকৃতি বেশি সময় শান্ত রইলো না। ঠিক বিকেল ৫টার সময়, হঠাৎ করেই বিকট বিস্ফোরণের মতো ১৫টি শব্দের গর্জন শোনা গেল। দূর থেকে ভেসে আসা কামানের শব্দের মতো সেই আওয়াজেই যেন শুরু হলো মহাবিপর্যয়।

আশেপাশের জনপদের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো প্রচণ্ড ভূকম্পন। এই কম্পন ৪ মিনিট ধরে স্থায়ী হয়েছিল, যার আনুমানিক মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৮.৮! এটি ছিল মূলত বঙ্গোপসাগরের নিচে আরাকান সাবডাকশন জোনে ঘটা এক মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প

🏞️ ভূপ্রকৃতি বদলে যাওয়া এক বিভীষিকা

এই ভূমিকম্প শুধু ঘরবাড়ি বা জনপদকেই ধ্বংস করেনি, একেবারে বদলে দিয়েছিল গোটা অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি। সেই সময়ের ঐতিহাসিক দলিলগুলোতে ভয়াবহতার এমন চিত্র পাওয়া যায় যা ভাবলে গা শিউরে ওঠে:

  • মাটি ফুঁড়ে কাদা ও জল: চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় বিশাল বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছিল, যার ভেতর থেকে সালফারযুক্ত গন্ধযুক্ত কাদা-জল ছিটকে বেরিয়ে আসছিল।

  • ভূ-উত্থান ও অবনমন: ভূমিকম্পের প্রভাবে টেকনাফ উপদ্বীপ এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ প্রায় ২-২.৫ মিটার উঁচু হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, কিছু উপকূলীয় এলাকা স্থায়ীভাবে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়।

  • নদীর গতিপথ পরিবর্তন: এই ভূমিকম্পের প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে গিয়েছিল, যা যমুনা নদী হয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

  • সুনামি ও জলোচ্ছ্বাস: মূল ভূকম্পনের পরই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল স্থানীয় সুনামি। সমুদ্র উপকূলের গ্রামগুলো ভেসে যায়। এমনকি কলকাতার হুগলি নদীতেও পানির উচ্চতা ৬ ফুট বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।

  • প্রাণহানি: তাৎক্ষণিকভাবে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায়, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। ঢাকার কাছাকাছি নদীপথেও প্রায় ৫০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: কথিত আছে, এই ভূমিকম্পের ফলে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে দুটি কাদামাটির আগ্নেয়গিরি (Mud Volcano) সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

🌑 যে দুর্যোগ আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে

১৭৬২ সালের এই ঘটনা কেবল একটি ঐতিহাসিক দুর্যোগ নয়, এটি আমাদের অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক কঠিন সতর্কবার্তা। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা বঙ্গোপসাগরের টেকটোনিক প্লেটের একটি সক্রিয় সীমান্তে বাস করি।

ভূ-বিজ্ঞানীরা আজও গবেষণা করছেন এই ভূমিকম্পের প্রকৃতি নিয়ে। তাদের আশঙ্কা, ১৭৬২ সালের মতো আরেকটি বড় মাপের ভূমিকম্প এই অঞ্চলে যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে।

এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতির শক্তি কতটা বিশাল আর অপ্রত্যাশিত হতে পারে। আমরা যেন আধুনিক জীবনযাত্রার আড়ালে ভুলে না যাই, মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই 'ঘুমন্ত দানব'-এর কথা, যে এক লহমায় পাল্টে দিতে পারে একটি জনপদের ভাগ্য।