কলেজের পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডি) সভাপতি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনে নিয়ে আসেন দামি মোবাইল ফোন। অধ্যক্ষ ওই মোবাইল ফোন কিনতে ব্যয় হওয়া অর্থ গভর্নিং বডির বৈঠক ডেকে বরাদ্দ করেন সভাপতির অনুকূলে। সভাপতি সেই টাকা গ্রহণও করেন। আবার শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সম্মানী হিসেবে সভাপতির অন্তত ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে, গভর্নিং বডির সভাপতির পাঠদানের এমন ঘটনার নজির বিরল। এই দুটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে। তবে এখানেই শেষ নয়, পরিচালনা পরিষদের স্বেচ্ছাচারিতা, ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ ও দুর্নীতির আরও বহু ঘটনা ঘটেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদনের ব্রডশিট (মন্ত্রণালয় নির্ধারিত ছকে তদন্তে পাওয়া তথ্যের বিস্তারিত উল্লেখ) জবাব থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে নগদে জমি কেনার নামে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে কলেজের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কলেজের বর্তমান কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলেজে গভর্নিং বডির বৈঠকে সভাপতির জন্য মোবাইল ফোন কিনতে ৮৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও এর বাইরে মোবাইল ফোন কিনতে আরও ১ লাখ টাকা নিয়েছেন তিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক নিয়োগ, দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নামে জমি কেনা, কলেজের উন্নয়নে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে কলেজের টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। ২০২০ সালের ডিআইএ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বিভিন্ন অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ডিআইএ-এর রিপোর্টের ব্রডশিটে জবাব চেয়ে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিট ও আইন শাখা। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর, ২০২১ সালের ২২ আগস্ট, ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, একই বছরের ২৪ এপ্রিল এবং ২০২৪ সালের ১৯ মে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে ব্রডশিটের জবাব চেয়ে আটবার মন্ত্রণালয় চিঠি দিলেও কলেজ ব্রডশিটের মাধ্যমে জবাব দেওয়া হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অধ্যক্ষ পরিবর্তন হলে ফের চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতেও কোনো কর্ণপাত না করায় এবং ব্রডশিটে জবাব না দিলে সর্বশেষ বর্তমান অধ্যক্ষের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। এর পর গত ৯ জুলাই গুরুতর অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়সহ গত পাঁচ বছরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ব্রডশিটের মাধ্যমে জবাব দেন বর্তমান অধ্যক্ষ বাদরুন নাহার চৌধুরী। সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রহমান ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এই তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও ব্রডশিটে জবাব দেয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কলেজের বেশিরভাগ অনিয়ম হয়েছে সাবেক অধ্যক্ষ, গভর্নিং বডির সভাপতি অধ্যাপক ড. হারুনর রশীদ খান ও তৎকালীন শিক্ষক প্রতিনিধি (বর্তমানে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ) আবু নাঈম মো. রাফিসহ একটি শিক্ষক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তাদের মধ্য থেকে অনেকে অবসরে গেলেও তাদের অবসর সুবিধার সব পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্রডশিটের মাধ্যমে সাতটি অভিযোগের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. হারুনর রশীদ খান নিয়মবহির্ভূতভাবে মোবাইল ফোন সেট ক্রয়ের নামে কলেজ থেকে ৮৩ হাজার ৯৬০ টাকা নগদ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সভার সম্মানী বাবদ বাজেটে বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করেছেন। টেলিফোন ও ইন্টারনেট বিল বাবদ বিধিবহির্ভূতভাবে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭৭ টাকা নিয়েছেন। একই দিনে একাধিক বিষয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রতি বিষয়ের জন্য পৃথকভাবে সম্মানী নিয়েছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন কাজে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অপ্রয়োজনীয় নিয়মবহির্ভূতভাবে ঘন ঘন বিভিন্ন সভা ডেকে সম্মানী নিতেন। সভাপতি হয়েও সাধারণ শিক্ষকদের মতো অর্থের বিনিময়ে এই কলেজে পাঠদানের নামে ৩ লাখ টাকার বেশি নিয়েছেন।’
এই অভিযোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রধান জবাবে বলেছেন, ‘কলেজের টাকায় মোবাইল কেনার বিষয়টি সঠিক। সভাপতির জন্য আমেরিকা থেকে মোবাইল এনে টাকা নিয়েছেন তৎকালীন প্রিন্সিপাল; কিন্তু অদ্যাবধি ভাউচার জমা দেননি।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, ‘হিসাববিজ্ঞান বিভাগের পিকনিকের উদ্দেশ্যে বিনা রসিদে শিক্ষার্থীপ্রতি ১ হাজার ৩০০ টাকা করে উত্তোলন করার অভিযোগটি প্রমাণিত। টাকা উত্তোলনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি ছিল না। এবং কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের নবীনবরণসহ (২০১৯) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজেটের চেয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করা হয়।’
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ‘হিসাববিজ্ঞান বিভাগের পিকনিকের উদ্দেশ্যে বিনা রসিদে শিক্ষার্থীপ্রতি ১ হাজার ৩০০ টাকা করে উত্তোলন করার অভিযোগটি প্রমাণিত। টাকা উত্তোলনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি ছিল না এবং কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের নবীন বরণসহ (২০১৯) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজেটের চেয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করা হয়।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ বাদরুন নাহার চৌধুরী তার মন্তব্যে বলেছেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কোনো অনুমোদন নেই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিধানেও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নেই। তারপরও মূল ক্যাম্পাস থেকে ১৬ থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে শিক্ষক-কর্মচারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জমি কেনা উদ্দেশ্যমূলক। জমি প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর নিম্ন জলাভূমিতে। জমির দলিল সঠিক না হওয়ার কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরা। জমির মালিকদের নিকট থেকে কম দামে জমি ক্রয় করে দলিলে বেশি দাম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি সঠিক। কমিশনের বিনিময় সাবেক সভাপতি, শিক্ষক পতিনিধি আবু নাঈম রাফি ৪ থেকে ৫ মাস অন্তর এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে কমিশন নিয়ে এফডিআর করাতেন। কলেজে সাব-স্টেশন স্থাপনের ক্ষেত্রে এনার্জিপ্যাকের মতো কোম্পানিকে টেন্ডার না দিয়ে নিজের পরিচিত ও পছন্দের লোককে কাজ দেন এবং কাজ সম্পন্ন করার আগেই রাফির তদবিরে ৭০ শতাংশ অর্থ দেন। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়। ৪০ লাখ ৭৬ হাজার ৩০০ টাকায় ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সাব-স্টেশন স্থাপনে বিলম্বের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কোনোরূপ বিলম্ব চার্জ না করে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।’ এ অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবু নাঈম মো. রাফিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে অনার্স প্রথম বর্ষের নবীনবরণ যথাসময়ে না করে ৬ থেকে ৭ মাস পরে সম্পন্ন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত। সাবেক সভাপতি গঠিত সিন্ডিকেট অর্থ কমিটির সদস্য সচিব আবু নাঈম মো. রাফি, শিক্ষক প্রতিনিধি নুরুন্নাহার বেগম, হিতৈষী প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন বর্তমান অধ্যক্ষ।
অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে কলেজটিতে অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করে আবু নাঈম রাফি ও তাদের সহযোগীদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতির প্রমাণ পায়। পরিচালনা পর্ষদকে বেশকিছু সুপারিশ করলেও কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি জমি ক্রয় সংক্রান্ত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করার নির্দেশনা দিলেও গত পাঁচ বছর হয়নি।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কলেজের সভাপতি হয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল মোজাদ্দেদী আল ফেছানী। এর পরবর্তী সব প্রতিষ্ঠানে আগের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত হলেও এই প্রতিষ্ঠানের চিত্র ভিন্ন। শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় আন্দোলন এবং লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বাদরুন নাহার চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘অতীতে কলেজে অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে। এখন এমন কিছু না হলেও সে ধারাই চলছে। আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছিল এবং তদন্তে তা উঠে এসেছিল তা উল্লেখ করে ব্রডশিটে জবাব দেওয়া হয়েছে। এখানে নতুন কিছু নেই। কলেজে যারা অনিয়ম, দুর্নীতি করেছে, তদন্তসাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কলেজে অনিয়ম, দুর্নীতি কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক সভাপতি হারুনুর রশিদ খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ও সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি আবু নাঈম রাফি কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কলেজ থেকে ব্রডশিটে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। কলেজের উন্নয়নকাজ ও জমি কিনেছেন সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান। আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই।’ তিনি এই প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল